ছায়ার পাখি।। অভিজিৎ সেন।।

এইসময় শিশু গাড়ির শব্দ শোনে। সে ত্বরিতে মায়ের কোল ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে। তার সমস্ত শরীরে আনন্দ আর অস্থিরতার বিদ্যুৎস্পর্শ। গাড়ির যান্ত্রিক শব্দ এবং অবিশ্বাস্য একটা চলমান আয়োজন শিশুকে উদ্‌ভ্রান্ত, আহ্লাদিত এবং আবেগস্পৃষ্ট করে। সে একলাফে বাইরে আসে এবং রোদে আর হাওয়ায় তার যাবতীয় চপলতা ও আনন্দ মিশিয়ে দৌড় দেওয়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য থমকে তার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। চুলশূন্য তার মাথা নীচে তার চোখদুটো অবিশ্বাস্য প্রাপ্তির শিহরণে ছটফটিয়ে ওঠে।

সে বলে, "মাওরে, মোর বাপ আসে!'

চন্দ্রাবলী ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত লাফ দিয়ে ওঠে। চিৎকার করে সে সবাইকে সতর্ক করে। বলে, ‘না – আঃ, কে কুনঠি আছেন গো, মোর চ্যাংড়াক্ ধরেন, মোর চ্যাংড়াক ধরেন –।'

সে সেখানেই আবার বসে পড়ে। আঃ, এই তাহলে আঘাত! শিশু এখন এই এগারো দিন পরে তার আসল আঘাত পাবে! এই তাহলে এই! অথচ তাকে তো জানতেই হবে! জানুক সে, এভাবেই তার মোহভঙ্গ হোক! যা হয় হোক, আমি আর ভয় পাই না। যে আমার সুখের দিন কেড়ে নিয়েছে, যে আমার শিশুর পৃথিবীকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছে, হে ভগবান, তার যেন, হে ভগবান, তার যেন-

অনিল ছুটে গিয়ে শিশুকে ধরে।

—কুনঠি যাহো, বাপ? মাওয়ের কাছে‍ যাও, মায়ের কাছে‍ যাও। 

—না, মোক্ ছাড়েন, কাকা। গাড়িৎ মোর বাপ আছে না! ছাড়েন মোক্‌! আঃ ছাড়েন!

শিশুর স্মৃতিতে এবং অভিজ্ঞতায় গাড়ি, ইঞ্জিনের রহস্যময় শব্দ, যা জৈবও নয়, আবার পুরোপুরি যান্ত্রিকও নয় যেন। সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার বাপও জড়িয়ে আছে। বছরখানেক আগে সে প্রথম গাড়ি দেখেছিল। সে ভয়ে দূরে লুকিয়েছিল, তার মায়ের আড়ালে। গাড়ি যত এগিয়ে এসেছিল, তার বিস্ময় তত বাড়ছিল। আর গাড়ি যখন তাদেরই ঘরের উঠানে এসে থেমেছিল, অবিশ্বাস্য এই ঘটনায় তার সমস্ত চঞ্চলতা রুদ্ধ হয়েছিল। সেই গাড়ি থেকে নরেন নেমেছিল। তখন তার বাপকেও তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়নি। বাপকে অচেনা লেগেছিল তার।

এর মাসখানেক পরে গাড়ি আবার এসেছিল। সেবার ভয় এত মারাত্মক ছিল না। সেবার সে বাপের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেউ একজন তার বাপের গলায় একগাছা কাগজের ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিল। সবাই খুব চিৎকার করছিল এবং হাসছিল। আর তার মা দূর থেকে এসব দেখছিল, হাসছিল, কাঁপছিল এবং আরো অনেক কিছু করছিল, তার শিশুচোখে যার কোনও অর্থ ধরা পড়ছিল না। সে সবাইকে বুঝবার চেষ্টা করছিল।

তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গাড়ি এই দুবার এবং এই দুবারই গাড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে তার বাপ নরেন। সে ছটফট করে, কিন্তু অনিলের কোল থেকে ছাড়াতে পারে না নিজেকে।

সে দাপাদাপি করে, ক্রুদ্ধ হয়, চিৎকার করে কাঁদে, শেষে চুল ধরে ঝুলে পড়ে অনিলের।

'শালা, খানকি, এবং আরো সব অবোধ গালাগালি দেয়, 'মোক বাপোর কাছে যাবা দিবে না! শালার বেট্‌টা শালা'—', ইত্যাদি।

কেউ একজন, সে সাগর, এগিয়ে এসে বলে, "ছাইড়ে দি, অনিল, যাবার দি। ওরও তো বুঝা নাগবে, এংকাই বুঝবা দি’ ওক্।

অনিল ছেড়ে দেয় তাকে। শিশু ছুটে যায় গাড়ির কাছে। তখন ইঞ্জিনের শব্দ বন্ধ হয়।

শিশু চিৎকার করে ডাক দেয়, ‘বাপ!’

গাড়ি থেকে সাড়া দেয় না কেউ, নামেও না।

শিশু আবার ঘুরে গিয়ে ওপাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকে, ‘বাপ!'

একটা বিশাল মঞ্চে এই ট্র্যাজেডি অভিনয় হচ্ছে যেন।

এক-দেড়শো মানুষ, একটা গাড়ি, আকাশ বৃক্ষময় প্রকৃতি, সবাই স্তব্ধ, শুধু ঐ শিশুটিই সরব, বিহ্বল, সচল। পর্দার চলমান ছবির মত সমস্ত আয়োজনটা নির্ঘাৎ এবং তীব্র।

হতাশ শিশু হতভম্ব হয়ে শেষে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখে অবিশ্বাস, হতাশা এবং অভিমান। তার ঠোঁট বাঁকে, মুখ ভেঙেচুরে টুকরো হতে থাকে।

তখন গাড়ির দরজা খুলে মথুর নামে। নামে আরো তিনজন মানুষ।

মথুর এগিয়ে এসে শিশুকে কোলে তুলবার চেষ্টা করে। শিশু ছিটকে সরে যায়, আছাড় খেয়ে পড়ে মাটিতে, সর্বাঙ্গে ধুলা মাখায়, ঠা-ঠা করে কাঁদে।

সাগর এগিয়ে এসে তাকে ধরে। সে কাঁদে।

সাগর তার গা-হাত-পা ঝেড়ে কোলে তুলে নেয়। সে কাঁদতে থাকে, কিন্তু আর অস্থিরতা করে না। শিশুকে নিয়ে একপাশে সরে আসে সাগর।

—মোর বাপ আসবে না?

সাগর মাথা নাড়ে।

—কুনঠি গেছেন মোর বাপ!

আকাশের দিকে আঙ্গুল দিয়ে সাগর বলে, 'ওঠি।'

শিশু আকাশের দিকে অনির্দিষ্ট চোখ তোলে ।

—মোর বাপ মরি গিইছে?

সাগর বলে, 'হঁ বাপ।'

—ক্যান্?

সাগর আর সহ্য করতে পারে না। শিশুকে দু'হাতে আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ওঠে এবং শিশুর বুকেই মুখ লুকায়।

শিশু তার কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে সাগরকে দেখে, তার লুকানো মুখ টেনে তুলবার চেষ্টা করে।

সাগর মুখ তোলে। খুব কষ্টে বলে, 'জানি না, বাপ।'

তারপর শিশুকে সে অল্পবয়সি একটি মেয়ের হাতে দিয়ে বলে 'যা দূরে কুনঠি নি যা, ভুলায়ে রাখ্।'

মথুরের চোখে জল। তার তিন সঙ্গীর মুখও বিষণ্ন ও গম্ভীর। মথুর বস্তুর দিকে এগিয়ে আসে। এদের গাড়ি থেকে নামতে দেখেই বস্তু উঠে এগিয়ে এসেছিল।

মথুর চেষ্টা করে কথা বলে। জিজ্ঞেস করে, 'কামকাজ সব মিটে গেছে?'

বস্তু বলে, 'হঁ, আপনারা ক-জন খালেই বেবাক মিটে যায়।' 

মথুর দৃশ্যতই বিব্রত হয়। বলে, 'না-না, আমরা খাব না, আমরা খাব না।' 

বস্তু শঙ্কিত হয়। এখন তার কী করা উচিত ঠিক হিসাব করতে পারে না। মথুর সম্পর্কে নরেনের সম্বন্ধী। কিন্তু তাদের সামাজিক দূরত্ব বিরাট। ব্যবধান কখনোই কাটে না। যাদের সঙ্গে বস্তুর সামাজিক সম্পর্ক, সেখানে ত্রুটি হলে নিজের লোকের কাছ থেকে নিন্দা শুনতে হবে। তাতে কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু এরা তো বাইরের মানুষ। বাইরের মানুষ, আবার কুটুমও। কীভাবে এদের সঙ্গে সামাজিকতা করতে হয়। মৃত জোয়ান ছেলের শ্রাদ্ধবাসরে তার বাপকে কী রকম আচরণ করতে হয়? তার কি নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে? সে যদি এখন নিরালায় কোনও অন্ধকারে, কোনও ঝোপের আড়ালে গিয়ে শুয়ে পড়ে, তবে কি খুব অন্যায় হবে?

ছায়ার পাখি
অভিজিৎ সেন

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৩৯০ টাকা
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।