বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

“বইভর্তি আলমারি? নাকি আলমারি ভর্তি বই?” আমার দিকে দাদা তাকিয়ে চোখ গোল গোল করে। প্রশ্নটা আমাকেই সে করেছে। আমি দাঁড়িয়ে আমাদের একশো কুড়ি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাড়ির দোতলার সিঁড়িতে। আমার হাতে উপচে ওঠা বই। দাদার হাতেও। এই শীতেও আমাদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এর মধ্যে বার পাঁচেক একতলা তিনতলা করে ফেলেছি আমরা। কারণ আজ বই রোদ্দুরে দেওয়ার দিন। বছরের একটা দিন বাবার মনে হতো বইয়ের রোদ্দুর পোয়ানো উচিত। সেদিন আর অন্য কিছু কাজ করা হতো না। সারাদিন বইয়েরা রোদ পোহাতো, তার সাথে বাড়ির সবাই। এমনিতেই এক তলায় যেখানে আমরা থাকি রোদ আসে না মোটেই। গরমকাল তাই আমাদের কাছে স্বর্গ মনে হয়। আর বর্ষার সময় থেকে দেওয়ালগুলো ভিজে উঠতে থাকে জোলো জোলো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে। শীতকাল হাড়ে কাঁপন লাগায়। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কষ্ট হয় বাবার। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাবার শরীর খারাপ হতে থাকে। একটু ঠান্ডাতেই বুকে সর্দি জমে। হাঁপানির টান বাড়ে। শরীরটাকে টেনে তখন শুধু স্কুল যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না বাবা। তাই শীতকালে একটু বেশি রোদের দরকার হয় মানুষটার। কিন্তু বেশি রোদ তখন কোথায়? ওটা যেন এক মহার্ঘ্য হয়ে দেখা দেয় আমাদের কাছে। 
অনেকদিন পরে ছাদের তালা খোলা হয়। অনেক দিন পরে সেই ছাদে উঠলে শীতের মিঠে রোদের মতো মনও ঝলমল করে ওঠে। একটা বড় শতরঞ্চি পাতা হয়। বইয়ের আলমারি থেকে বের হন শতবার্ষিকী সংস্করণের রবীন্দ্রনাথ। সাথে থাকেন শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমেরা। বের হন অনেক দিন পরে বিবেকানন্দ তাঁর সমস্ত খন্ড নিয়ে। এছাড়াও থাকে ঠাকুমার ঝুলি, ক্ষীরের পুতুল, নীল ঘূর্নি, পৃথিবীর পথে আরও কত কত কি। ন্যাপথলিন, দোক্তা পাতার গন্ধ চারিদিকে ভুর ভুর করে। শীতের নরম রোদ এসে পড়ে বইগুলোর ওপর। ছাদে ওঠার স্বাধীনতা বইয়ের পাতার সাথে হাওয়ায় ওড়ে। চারপাশে খেলে বেড়ায়। রেলিং দিয়ে পাশের পুরনো লালবাবা কলেজের বিল্ডিং-এ গোঁত্তা খেয়ে পাপ্পুর ঘুড়ির মতোই আবার ফিরে আসে। কার্নিশের ওপর দিয়ে দূরে বাবাইদের ছাদে বাবাইকে ডাকা যায়। একটা হুলুস্থূল পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। মনে হয় বাড়িতে যেন একটা উৎসব হচ্ছে। বই রোদে দেওয়ার উৎসব। শীতের রোদ পিঠে নিয়ে চরকির মতো বনবন করে ঘোরার উৎসব। কিন্তু এই মুহূর্তে সিঁড়িতে দাদার প্রশ্নে দাঁড়িয়ে। “বই ভর্তি আলমারি? নাকি আলমারি ভরতি বই?” ডিমটাই আগে ছিল না হাঁসটা? মাঝে মাঝে গুলিয়ে দেওয়া দাদার প্রশ্নে বিরক্তি লাগে। আমার সাফ জবাব বইভর্তি আলমারি। কিন্তু মুখে বলছি না। জানি বললেই এক্ষুনি বলবে, “মোটেই না। আলমারি ভর্তি বই।” তারপরে ঝগড়া হয়ে সকালটাই মাটি হবে। কাজেই চুপ। জানি না বলে এক সিঁড়ি দু সিঁড়ি করে উঠতে থাকা। আসলে সেই আলমারিটাকেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে নাকি বইগুলো? নাকি দুটোই? আলমারি খুললে ওখানে অনেক কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল পাওয়া যায়। সেগুলো নিয়ে দুপুর গড়িয়ে খেলা যায়। তাকে সাজানো বইগুলো দেখতে ভালোলাগে। বাবা কেমন  আলমারি খুলে বই দেখে দেখে কত লোকজনকে কত কিছু বলে দেয়। নকল করতে ইচ্ছে করে। একটা বড় বই টেনে নিয়ে, নাকের ডগায় বাবার ভাঙা চশমাটা পরে “আমি আজ কানাই মাস্টার/পোড়ো মোর বিড়াল ছানাটি/ আমি ওকে মারি নে মা বেত/মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি/রোজ রোজ দেরি করে আসে/পড়াতে দেয় না তো ওতো মন/ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই/ যত আমি বলি শোন শোন...”। অথচ আমার কথা কেউ শোনে না। এমনকি বাবার ইয়াশিকাও না। বইভর্তি আলমারি যার সাথে আমার সারা দুপুরের ভাব অথচ তার সাথে একটাও ছবি থাকে না আমার। দাদার থাকে। থাকবে না কেন? দাদা যে বই পড়ে। শুধু তাই না বই পড়ে সবাইকে শোনায়। গড় গড় করে গল্প করে। ইয়াশিকাও ক্লিক ক্লিক...ঠিক ঠিক বলতে বলতে আলমারির সামনে দাদার ছবি তোলে। লেপের ওপর বসে। বালিশে ঠেসান দিয়ে। একটা হাত আবার গালে দেওয়া। আর তার ছোট্ট ভাই? সে কোথায়? সে নিজেও জানে না। বহুদিনের পুরনো নেগেটিভ থেকে সদ্য হয়ে আসা প্রিন্টগুলো কতদিন পর আবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। কোন এক সকালে কবেকার বইয়ের আলমারিটা আবার হঠাৎ নতুন করে গল্প বলতে শুরু করে। উনুন থেকে ধোঁওয়া ওঠা কবেকার ফেলে আসা এক শীতের সকাল ঘিরে ধরে আমাদের। সেই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনো যায় না সহজে।

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ রূপায়ণ: শোভন সরকার
অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।