অনন্যবর্তী।। দুর্লভ সূত্রধর।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের উপন্যাস ' অনন্যবর্তী ' পড়ে লিখেছেন রামামৃত সিংহ মহাপাত্র। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। 
..........................................

নতুন লেখকের লেখা পড়ায় একটা আলাদা কৌতূহল থাকে।এর আগে আমি দুর্লভ সূত্রধরের কোন লেখা পড়িনি।সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের লেখা অনন্যবর্তী পড়তে আগ্রহ জাগায় উৎসর্গ পত্রের লাইনগুলি-"ঘরেও নহে,পারেও নহে,/যে জন আছে মাঝখানে',..../সেই তাঁদের/প্রতিদিনের বেদনাকে/সেই তাঁদের/জেগে ওঠা ভোরগুলোকে।"
     পড়তে কখনো মনে হয়েছে এই উপন্যাসে লেখক তুলে ধরতে চেয়েছেন মফস্বলের এক দঙ্গল ছেলেমেয়েকে, আবার কখনো মনে হয়েছে এ উপন্যাস কতগুলো পরিবারের গল্প। শেষ করে মনে হয় এই উপন্যাস একটা সময়ের গল্প বলতে চেয়েছে।যে গল্প আবর্তিত হয়েছে কুন্তি নদীর পাড়ের গ্রাম গ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে।সেই সময়ের গল্প যখন,গ্রামে গ্রামে পূর্বতন জমিদারেরা দুর্বল হয়ে জেলা সদর বা মহকুমা শহরগুলিতে পূর্বপুরুষদের করে রাখা নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন-তাঁদের বদলে গ্রামে দেখা দিয়েছে বড়ো বড়ো জোতদার। এই জোতদারেরা একই সঙ্গে সুদখোর মহাজনও বটে।ক্ষুদ্র কৃষকদের জমি এরা প্রতিদিন গিলে খায়,ভাগ চাষিদের ফসল দখল করে।
    অন্যদিকে রয়েছেন সতীশচন্দ্রের মতো মানুষেরা,যারা জমিদারীর আভিজাত্য থেকে বেরিয়ে বাজার থেকে "একটি তোলা উনুন, কিছু ছোটমাপের চেরা কাঠ।একটি হাঁড়ি, একটি কড়াই কিনে স্ত্রী তরুবালাকে নিয়ে সংসার পাতেন।একটা বৃত্ত তৈরি হয় শচীপ্রসাদ, ফণিভূষণদের সঙ্গে।যাদের জীবন আবর্তিত হয় এমন একটা পরিবেশে যেখানে প্রয়োজনমতো কেরোসিন তেল পাওয়া যায় না।সন্ধ্যো হলেই আলো নিভে যায়।চারিদিকে নিত্য-নতুন অশান্তি।চালে ধান আর কাঁকড় ভর্তি।রেশনের চালে বোঁটকা গন্ধ। গলাগলা ভাত হয়।মাছ পাওয়া যায় না।চিনি খোলা বাজারে অমিল।সব জিনিসের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই।মনে হয় কাব্যি করে বলা,"আমার সোনার বাংলা কবেই মরে হেজে গেছে।
যে পরিবেশে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে অনুভূত হয়,"কলিকালে বাজার করে খাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো শাস্তি।"
এর মধ্যেও তনয় টের পায় তার সমবয়সী কাজুর গায়ে সোঁদা মাটির গন্ধ আছে।টের পেয়েছিল কাজুর গায়ের গন্ধে মাইগ্রেন নিরাময়ের ইন্দ্রজাল আছে।
আবার এই পরিবেশ শচীপ্রসাদের মতো মানুষদের মনে প্রাণে বিশ্বাস করায় "জীবনটা একটা ডুবোপাহাড়ের মাঝখান দিয়ে জাহাজ চালানোর মতো।ধাক্কা লাগলে জাহাজ হয় আটকাবে নতুবা ডুববে।"কিন্ত উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত তাঁর জাহাজ কোথাও আটাকায়নি বা ডুবে নি।বরং বরাবর ভেসে থেকেছে দু চোখ স্বপ্নের মতো।যে স্বপ্নের শরিক হয়েছে ছেলে প্রতি এবং মেয়ে টুকু।
    আসলে তখন মফস্বলের বাবা-মায়েদের ছেলেমেয়েদের কিছু দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও একটা আদর্শ বুনে দেবার মতো সামর্থ্য থাকতো।এ নিয়ে যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল তা স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন লেখক,"নবুটা একটা ভালো জামা চাইলে কোনোদিন কিনে দিতে পারিনি ,টিপু-পিপু যে শাড়ি পড়ে কলেজে যেত,তা শহরের কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে পরে না।কারও পাতে ইচ্ছে হলেও আর এক টুকরো মাছ কোনদিন দিতে পারিনি। মাছের টুকরো তো কাজের লোকে করতেই চায় না,বলে-হাতে কেটে যাবে দিদি।একেই তো বলো সংস্কৃতি।তোমার মতো রাত জেগে বই মুখে করে বসে থাকা-একেই তো বলো কালচার!"
     এই ভাবেও বড় হয়ে উঠতে উঠতে একসঙ্গে স্বপ্ন দেখে তরণী, তনয়,তপেশ,শিবু, মনোজ, টুকু, কাজু,কৃষ্ণা প্রমুখ।প্রত্যেকটি চরিত্র লেখনের বলিষ্ঠ লেখনীর গুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।ওরা শুধু পড়াশোনাই করে না,নাইট স্কুলে পড়াতে যায়,গ্রাম গড়ার স্বপ্ন দেখে।এই সব করতে করতে প্রেম-ভালোবাসায় গড়া একটা সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে।স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রেমে পড়ে। নিজেদের প্রেম ছড়িয়ে দেয় প্রত্যেকে প্রত্যেকের পরিবারে।যা মফস্বলের পরিবার গুলোকে বেঁধে রাখে প্রেম প্রীতির বন্ধনে।নিজেরা খুশি থাকে।খুশি থাকে এই কারণে,তারা বিশ্বাস করে,"মানুষ যতই বড়ো হয়,তার খুশি হওয়ার ক্ষমতা ততই কমতে থাকে।"তাই উঠতি বয়সে খুশি খুঁজে নেয় পাটের, গন্ধ, ধান সেদ্ধর গন্ধ, মোটা চালের ফুটন্ত ভাতের গন্ধ আর তারা দেখতে দেখতে এলোমেলো গল্প কিংবা শিরশিরে বাতাসে দুজনে গাছির বিলের ধারে বেড়ানো, নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত-মাজা বা সকালে লাল মুড়ি খাওয়ার মধ্যে।
     ব্যক্তিগত কষ্ট মিশে যায় পরিস্থিতির কষ্টের সঙ্গে,"জরুরি আইন, নানা ধরনের কানুন, রাষ্ট্রশক্তির দাপাদাপি, বিরোধীদের পাইকারি ধরপাকড়, মিটিং মিছিলের কষ্ট মিশে গেলে টুকু যখন  বলে,"তুমিও তো আমাকে কত কষ্ট দাও"।কুন্তীর বুক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়।সেই বাতাস গায়ে মেখে মনে হয়,"পরিকল্পনা করে কিছু করার সুযোগ আমাদের মতো পরিবারের ছেলেমেয়েদের নেই।" সংলাপ আর চিত্র গুলি লেখক এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পড়তে পড়তে মন একটা অদ্ভুত কল্পনার জগতে চলে যায়।যেখান থেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় অবনের।যারা মুখে আদর্শের কথা বললেও বাস্তবে তা মেনে চলে না।তাই কৃষ্ণার মতো মেয়েদের বলতে হয়, "ভেবেছিলাম তোদের অবনদার বিরুদ্ধে অনেক নালিশ করব,কিন্ত পরে ভেবে দেখলাম, সেটা খুব হ্যাংলামি হয়ে যাবে।এত অপমান সইবে না।অবনরা নারীর অধিকারের সপক্ষে মুখে যাই বলুক পুরুষ হওয়ার সুবিধাটা ষোলো আনা উপভোগ করতে চায়, আর মেয়েদের ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র ভাবে।
  চমকে উঠতে হয় জাহান আলির মতো মানুষদের বিবেক দেখে।কুন্তী নদী নির্ভর যাদের জীবন নদীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা দেখে।নদী কেন্দ্রিক জীবন তাই নদী তাদের মা।তাই তারা বলে,"কন্নের মতো আমরা সব মায়ের কানীন সন্তান গো,আমাদের চিরদিনের দুঃখিনী মায়ের অধম সন্তান। মায়ের নামটা নায় মুকে নাই নিলাম।"
   আসলে রৌদ্র-ছায়ার মিশ্রণে রচিত এই উপন্যাস পড়তে যতই মনে হোক না কেন প্রতিটি সকাল আসে বিমর্ষ হয়ে,প্রতিটি সন্ধ্যা আলোহীন ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে থাকে,তবুও আশা জাগায় শটিডাঙ্গা।শচীপ্রসাদের অবসরের পর তার কেনা জঙ্গুলে জমি সবার সহযোগীতায় নিবিড় বসবাসক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে তাতে সম্পর্কের যথার্ত উত্তোরণ ধরা পড়েছে।উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কোন চরিত্রকে মনে হয় নি লেখকের কষ্ট কল্পিত বরং মনে হয়েছে সদাব্যস্ত সমাজের হেঁটে চলা মানুষ। এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা।জড়তা নেই লেখকের কলমেও।তাই লেখক তুলে আনতে পেরেছেন "বৃহত্তর অন্তর্জীবন এবং বহির্জীবনাহৃত দর্শনাভিজ্ঞতার অনুভব-অসম্ভব বিষন্নতা থেকে সম্ভাবনাময় উজ্জীবন ও উদ্দীপনার অফুরান প্রাণকথা।"এখানেই লেখকের সার্থকতা।

অনন্যবর্তী 
দুর্লভ সূত্রধর 
সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।