আহাম্মকের খুদকুড়ো।। দুর্লভ সূত্রধর।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের বই আহাম্মকের খুদকুড়ো পড়ে লিখেছেন দেবলীনা চক্রবর্তী। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.....................................................................

📚পুস্তক - আহাম্মকের খুদকুড়ো📚
🖊লেখক - দুর্লভ সুত্রধর🖊
📜প্রকাশক - সুপ্রকাশ📜
📖পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১৮৯ পাতা📖
💵মুদ্রিত মূল্য - ২৮০ টাকা💵
 কথা বলা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে...
এটা ভালো লক্ষণ বোধহয়.. তাছাড়া শোনবার লোক যে হারে কমে যাচ্ছে, তাতে এই একা বোকা টা আর যাবেই বা কোথায়? কথাই বা আর কি বলবে? কাকেই বা বলবে? শোনার লোকই বা কোথায়!
আমাদের মনি বাবু বলেছিলেন,''কথা বলার ইচ্ছে হলে মানুষকে বেশি ঘাঁটিও না বাপু। মানুষ শুধু নিজের কথা বলে, কেউ কারো কথা শোনে না!!
তার চেয়ে কিছু বলবার ইচ্ছে হলে লিখে রাখো কল্প খাতায়, ভেবড়ে যাওয়া পুঁথির পাতায়... আর যদি সে সব কাছে না থাকে তবে তোমার কথা আকাশকে বলো, বাতাসকে বলো, কিংবা গাছপালাকে বলে রাখো..''
কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী -- আকাশ ব্যাপারটা বড্ড সুদূর, অত পর্যন্ত বামুনের হাত পৌঁছবে না.. তাছাড়া আকাশ মানে তো শূন্য থেকে মহাশূন্য, শূন্যতার কাছে কিছু বলতে ভালো লাগে?? ইদানিং আকাশেরও আর শোনার মত ক্ষমতাও নেই, ওজোন স্তর ফুটো-টুটো হয়ে যাচ্ছেতাই কান্ড... বাতাস এত পল্যুটেড যে, তার কান আর চোখ দুটোই একেবারে গেছে.... তাছাড়া যাকে দেখা যায় না, অথচ আছে বোঝা যাচ্ছে, তাকে কোন কথা বলা মুশকিল... গাছের কাছে গিয়েও বলা যায়, কিন্তু  গাছগুলো নিজেরাই এত অসুস্থ,কর্তনাশঙ্কায় সদা সর্বদা এত কম্পমান, যে তাদের কথা কে ভাবে তারই ঠিক নেই...
তবু কথায় কথা বাড়ে। আর বাড়ে চুল-দাড়ির ইন্দ্রজাল। তাই কেউ শুনলে ভালো, না শুনলে তো আরো ভালো। জীবনের দিকচক্রবাল ঘেঁষে যত খুঁদকুড়ো জমা হয়েছে সবই তো যাকে বলে,রস-কষ-সিঙাড়া-বুলবুলি -- শুধু মস্তকটাই নেই এই যা। আহাম্মকদের তো ওটাই স্বভাব। সবকিছু গজাল মেরে গোঁজানো যায়না,আহাম্মকেরাতো শুধু পারার মধ্যে পারে জীবনের ফেলে দেওয়া খুদকুড়োগুলোকে জড়ো করে রাখতে।
"ডুমাটোলার দাদু বলেছিলেন, 'বুঝলে দাদুভাই, এই জীবনটা ছাড়া জীবনে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই। হমারা জীবন সির্ফ হমারা অকেলা নহি হ্যায়, সবারটা মিলিয়ে তবে আমাদের এক-একটা জীবন। তোমার জমানো খুদকুড়োর মধ্যে দেখবে আছে কত লোকের জীবনের দিনরাত, কিতনে লোগো কো জীবিত রহনা। কতজনের কত কথার কত শব্দ, দিল কী বাত, কতজনের কত গান, বুদ্ধি কী কিতনা সুগন্ধ, বিচারো কা হীরা-জহরৎ। সোচো দাদুভাই, ইয়ে কেবল আপকি চিজেঁ নহি হ্যায়---বলতে গেলে তোমারই নয়। তাই আলো-ভালোগুলোকে আগলে রেখো। যেদিন দেখা যাবে খুদকুড়োও নেই, ফুটন্ত ভাতের গন্ধ নেই কোথাও, সেদিন হয়তো এগুলোরই খোঁজ পড়বে। কোনোকিছু অপচয় করো না। ইয়াদ রাখনা, অপনে দিলমে কোই তরহা কোই অপেক্ষায়েঁ রাখা চলবে না। অর ফির ইসকে লিয়ে অপনে আপ মে কোই অভিমান নহি রাখনা চাহিয়ে।" -----
 কিন্তু আমাদের চারপাশে এই তাৎক্ষণিকের জীবন?? যেখানে লক্ষ্য একটা বিন্দু, আর উপলক্ষ বিন্দুটার চারপাশের বিরাট শূন্যতা!!
 আর কি... সহসা পিটুলি গাছের সেই নাম না জানা পাখিটার উল্লশিত ডাক শুনেই যেন ভেতরে বসে থাকা আহাম্মকটা বেরিয়ে এসে বলে -- '' আমি তো ছিলামই, আমি তো আছিই, আমি তো থাকছিই!!'' 
এভাবেই তো আলাপ জমে।।
🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
আমাদের ফেলে আসা অতীত সময়কে পুনরায় ফিরে পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় কি বলুনতো?? বই। একমাত্র সেখানেই আপনি সেইসব পুরোনো রাস্তাঘাট, বাড়ির কার্ণিশ, আখের রস বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালা কিংবা সোডিয়াম ল্যাম্পের স্ট্রিট লাইট, আর সেই আলতা পড়াতে আসতো আলতা বৌ, আরও কত কি সব হারিয়ে যাওয়া অতীত ফিরে পেতে পারেন। 
তারপর ধরুন সেই স্কুল জীবনের রিপাবলিক আর পাবলিকরা। আমাদের সময়ে স্কুলে গিয়ে, টিউশনি তে গিয়ে বই পড়া ছিল সেকেন্ডারি কাজ। ওটা না করলেও আমরা বছর শেষে ঠিক গড়িমসি করে পাস করে যেতাম। কিন্তু গোটা বছর জুড়ে দেওয়াল পত্রিকার লেখা সংগ্রহ করা, টিফিন বাক্সের ঢাকনা দিয়ে পিঁয়াজ আলু কেটে কেটে আলুকাবলি পিকনিক , কিংবা পড়তে গিয়ে সাইকেল রেস... এইসব আমাদের সময় প্রাইম কাজকর্মের মধ্যে পড়তো। 
আমাদের সাদামাটা জীবনে পুঁজিপাটা ছিল কম। তবুও কি করে যেন ছন্দিতা নামের সেই মেঘদূতীর মুখে বাহ্যত ফুটে না ওঠা দুঃখের রেখা সে পড়তে শিখিয়েছিলো। এই সরলরেখায় এগিয়ে যাওয়া জীবনটাই শিখিয়েছিলো সব কথা সবাইকে বলতে নেই। সবকিছু সবার জন্য নয়। 
🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂🍂
এর পূর্বে কোনো আত্মজীবনী সেভাবে মনে দাগ কাটতে পারেনি বহুদিন। যখন অক্ষয় মালবেরি পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী বোধহয় আর হয় না। তবে এই বই ঠিক আদ্যোপান্ত আত্মজীবনী নয়। 
১৮৯ পাতার বইখানাকে লেখক ভাগ করেছেন একুশ খানা পর্বে। সেই পর্বে কখনো এসেছে জ্বরমুখে পোড়ের ভাতের স্বাদ, কখনো বা পিতলের নাগরা-জুতোর বিস্ময়। জলখাবারের সমারোহ অথবা নিখুঁত সুতার টানে আধখানা ডিম খাওয়ার নিত্য নৈমিত্তিক মধ্যবিত্ত যাপনের অভ্যেস পেরিয়ে গোটাগোটা দুটো ডিম খাওয়ার বিস্ময়। শ্রেণীর বিস্ময়। সরকারি স্কুলে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত  শ্রেণীর ছাত্রের মাঝে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কোনো প্রতিনিধির বৈভবের বিচিত্র বিস্ময়, যে কিনা গোটা দুটো ডিম প্রাতঃরাশে পায়--- সেসব লেখকের স্মৃতির সীমানা ছাড়িয়ে আমাদেরকেও ছুঁয়ে যাবে। মা অন্নপূর্ণা আর দয়াবতী দিদিদের মুখে কখন যেন আমাদের ঘরের অন্নপূর্ণা কিংবা দয়াবতীদের আদল ফুটে উঠবে। আর স্মৃতি হাতড়ে লেখকের মতো আমরাও দুঃখু-দুঃখু মুখ করে ভাববো "---মায়েদের অনন্ত পরমায়ু পাওয়া দরকার---আমাদের সেদিনের বয়েসটা আর আজকের সক্ষমতাটুকু একসঙ্গে থাকলে কত যে ভালো হতো!' 
আমাদের মতো পাবলিকেরা, যারা কিনা ভাঙা ভাঙা দরজা, সংকীর্ণ অফিসঘর, দেওয়ালে দেওয়ালে পরীক্ষার টুকলিক্রিয়ার কালিমাসহ কোনো আদ্যিকালের পুরোনো ঘরে শিক্ষাজীবনের কয়েক ধাপ পেরিয়ে এসেছি, তাদের সাথে লেখকের 'রিপাবলিক ও তার পাবলিকেরা' অবলীলায় এসে জুড়ে যাবেন। 'রিপাবলিকের সাড়ে-সতেরো মজা' পেরোতে পেরোতে আমরা চলে যাব রিপাবলিকের দেওয়াল পত্রিকার অভিনব সব মণি-মুক্তোয় ভরা বিচিত্র ও মৌলিক রচনায়। স্কুলের প্রতি প্রেম নিবেদন করে চার চরণের পয়ার, মানিক্য'র 'পিঁপড়ে-পোষার উপকারিতা' নামক গূঢ় চিন্তার নিবন্ধ কিংবা ক্লাস নাইনের অমৃতের ইলিশ ও নারকেল নিয়ে সাড়া জাগানো নিবন্ধ  'ইলনারতত্ত্ব' আমাদের নির্মল আনন্দ দিয়ে যাবে। মাণিক্যকে শেষমেষ তার বন্ধুরা ডেঁয়ো পিঁপড়ের ঢিবিতে পাঠিয়েছিলো কিনা, কিংবা অমৃত ইলিশ নারকেল তত্ত্ব ভজনার জন্য রিপাবলিকের নানাবিধ গঞ্জনা পেরিয়ে  শেষমেষ 'ইলিশ ও নারকেল সেলিব্রেশন' বন্ধ করেছিল কিনা, সেকথা লেখক আর সবিশেষ জানাননি। তবে এইসমস্ত মৌলিক ও বিচিত্র রচনার ফলে মাস্টারমশাইয়েরা যে আর দেওয়াল পত্রিকা নিয়ে খুব বেশী স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না, একথা 'ইলনারতত্ত্বে'র শেষে লেখকের ভাষ্যেই জানতে পারি আমরা। 
প্লেটোর রিপাবলিকের মতোই লেখকের রিপাবলিকও ছিলো একটি আইডিয়াল কমনওয়েলথ বা আদর্শ রাষ্ট্র। সে রিপাবলিকের মাস্টারমশাইয়েরা ছিলেন নিজের নিজের ক্ষেত্রে স্বরাট-সম্রাট। ইস্কুলের মনোগ্রামে লেখা 'তমসো মা জ্যোতির্গময়' শ্লোকটির মতোই তাঁরা সেই রিপাবলিকের নাগরিকদের অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যাওয়ার ঐকান্তিক চেষ্টা করে যেতেন। শুধু পড়াশোনায়-ই নয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই। "পরিস্থিতি আর যুদ্ধ-সময়" পর্বে যা আরোও স্পষ্টভাবে আমরা দেখতে পাব। লেখকের মুন্সিয়ানা এখানেই তিনি শুধু হাসি-মজাতেই রিপাবলিককে বেঁধে রাখেননি। বরং তার ফাঁকেই বলে গেছেন জীবনের গূঢ় কথাও। বোধের কথা। যেখানে ম্যাজিক লন্ঠনওয়ালা রহিমুদ্দি'র 'হিরণ্যকশিপু বধ' আর 'দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ" পালার প্রত্যেক দফা বর্ণনার পর শ্রোতাদের উচ্চকিত জয়ধ্বনি আমাদের মাঝে একটা যুগ বা সময়কে নির্মাণ করে দিয়ে যায়। যে সময়টা আজকের এই চুড়ান্ত মেরুকরণের সময় থেকে ছিলো অনেকটাই আলাদা। যেখানে রহিমুদ্দীদের অভিনব সুন্দর গলায় --
"কহ দামোদর, কৌরব ঈশ্বর
ভীমে গদা প্রহারিল।
ভীম মহাবল, হইয়া বিকল,
যুদ্ধে হৈল অচেতন।।" 
হেরে যাওয়া প্রণবদার বিষাদ চোখের কাছে চিক-চিক করার মাঝেই আমরা দেখতে পাবো ছন্দিতাদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। আর সে বিষাদগাঁথা বুকে নিয়ে এক আহাম্মককে, "যার সাদা-মাটা জীবনে পুঁজি-পাটা ছিল কম। তবু কী করে যেন ছন্দিতা নামের সেই মেঘদূতীর মুখে বাহ্যত ফুটে না-ওঠা দুঃখের রেখা সে পড়তে শিখেছিল। আ-কৈশোর ত্বকের ভেতরে সেই বালিকার মুকুল-মুকুল গন্ধকে লালন করেছিল--- নিজের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ঝিম্-ধরানো নৃত্যের ছন্দকে অভিযোজিত করেছিল সে। সেই ছেলেটিই একমাত্র বুঝতে পেরেছিল---'বেদনার পরম গোপন কথাখানি'--- যে কথা কাউকে বলা যায় না, কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।" গোপন দুঃখ বুকে নিয়ে সে কিশোরকে তার পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাবো  রূপেশ্বরী নদীর পাড়ে। এপার ওপারের পারাপার দেখতে দেখতে, শ্যাম ঘোষের অপূর্ণ জীবন বয়ে চলার মাঝে দরদ ঝরে পড়া কণ্ঠে --- "ও আধে গো/চইলা গেলি কেনে?/মোরে ফেইলা কুথায় গেলি?/কোন্ সুখেরই টানে/চইলা গেলি কেনে?" শুনতে শুনতে আহাম্মকটাও অস্ফুটে বলে উঠবে --'আমি তো ছিলামই, আমি তো আছিই, আমি তো থাকছিই!' আর এভাবেই নিজের নিজের রূপেশ্বরীর জলে সমস্ত দুঃখ ভাসিয়ে পাঠকও সেই ডুমাটোলার দাদুর কথা-র মতো - 'আলো-ভালোগুলোকে আগলে রাখতে' আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে। গলার কাছটার ব্যথা অথবা চোখের কোনের চিক-চিক নিয়েই।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।