শেষ মৃত পাখি।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।
সুপ্রকাশ প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শেষ মৃত পাখি' পড়ে লিখেছেন সুস্মিতা বসাক। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
......................................................................................
"সে কি রাত্রির শেষ মৃত পাখি, যার স্মৃতি আঁচড়াল
মৃত্যুর ঘন ছায়ায় দেবযান
ভয়ের মতন মৃদুসঞ্চারী স্বপ্নের পিছু নিতে?
স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে।"
সালটা ১৯৭৫ এর জুন মাস, খুন হয় দার্জিলিংয়ের এক সম্ভাবনাময় কবি অমিতাভ মিত্র। অভিযোগের তীর যায় তারই বন্ধু রহস্য ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। তবে উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় সে অভিযোগ দাঁড়ায়নি। কিন্তু মানুষের চোখে তার প্রতি ভাবমূর্তি বদলে যায় চিরতরে।
এর ঠিক চুয়াল্লিশ বছর পর ২০১৯ এ তনয়া ভট্টাচার্য আসে দার্জিলিংয়ে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক কাহিনী লেখে সে পত্রিকায়। দার্জিলিংয়ে আসার উদ্দেশ্য চুয়াল্লিশ বছর আগের ঘটে যাওয়া অমিতাভ মিত্রের রহস্য কাহিনীকে কবরখানা থেকে তুলে সভ্য সমাজে আনতে। কিন্তু রহস্য কাহিনীর রসদ জোগাড় করতে গিয়ে এ কোন গোলকধাঁধার মধ্যে পড়লো সে!
অন্যদিকে সমান্তরালে এগোচ্ছে অমিতাভ মিত্রের লেখা উপন্যাস। যেখানে দেখা যায় গোয়েন্দা শুদ্ধসত্ত্বর কাছে মাধব রক্ষিত নামক এক ব্যক্তির চিঠি আসে যে আনিসুর রহমান তাকে খুন করতে চায়। আর এর থেকে নিস্তারের জন্য সে শুদ্ধসত্ত্বর সাহায্যপ্রার্থী। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে পরেরদিন একটি বন্ধ ঘর থেকে আনিসুর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
আনিসুর যদি মাধব রক্ষিতকে খুন করতে চায়, তাহলে তাকে খুন করলো কে? এটা কি কাকতালীয় নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো রহস্য?
একাত্তরের দশকে দার্জিলিংয়ের ত্রাশ ছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর ড্যানিয়েল লামা। অপরাধের গন্ধ পেলেই বন্দুকের আগুন দিয়ে তা নিভিয়ে দিত। কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে রাতারাতি তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হলো?
এরকম অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সাংবাদিক তনয়াকে। চুয়াল্লিশ বছর আগের তামাটে হয়ে যাওয়া স্মৃতি, যা আজ অনেকেরই মনে নেই, শুধু মনে নেই না, সেই সময়ের অধিকাংশ মানুষই আজ বেঁচে নেই, এতো বাঁধা টপকে তনয়া কি পারবে রহস্যের কিনারা করতে?
"তুমিই দাঁড়াও তাই
বেলেল্লা রাস্তার মোড়ে
অন্ধতার বিষ ঢেলে চোখে
কেননা এ আত্মরক্তপাত
ঘূর্ণি তোলে অঘ্রাণেও
জ্বলে যায় প্রত্যাশী খামার
সিংহাসনে ক্লীব আর
শুতে গেছে যুবারা শ্মশানে"
গোটা বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সত্তরের দশকের ছোঁয়া। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে, সাহিত্য জগতের পলিটিক্স, লিটল ম্যাগাজিনের বেঁচে থাকার লড়াই, কবিতার মাধ্যমে তরুণ কবিদের আন্দোলন, কী নেই বইতে। শুধু তাই নয় দার্জিলিংয়ের মনমুগ্ধকর পরিবেশকেও লেখক দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।
"সাহিত্য না থাকলে শুকনো মগজের খেলা কতদিন আর ভালো লাগে মানুষের।"
তবে এই বইকে নিছক কোনো রহস্যের বই বলা যায় না। রহস্যের সাথে গোটা বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো গদ্য, কবিতা। আর বলতেই হয় এগুলোও এই বইয়ের প্রাণ। তাই এই বইকে নিছক একটি রহস্যের বই বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।
"মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।"
সত্যিই তো, মানুষ চলে যায় ঠিকই, কিন্তু তার স্মৃতি থেকে যায়।
অনেকদিন পর কোনো থ্রিলার পড়ে এতোটা চমকিত হলাম। সত্যি বলতে থ্রিলার আজকাল খুব একটা পড়া হয়না। তার প্রধানত কারণ প্রেডিক্টেবল ঘটনা। একটা সময়ে এতো থ্রিলার গোগ্রাসে গিলেছি যে নতুন কোনো বই কিছুটা পড়ার পর অনেকটাই বোঝা যায় যে এরপর কী হতে পারে। কিন্তু এই বইটা আমাকে ভুল প্রমাণ করলো। যতোবার ভেবেছি যে, এবার জানি কী হবে, ততোবার দেখলাম যে আমি ভুল। ৪০২ পাতার বই, ভেবেছিলাম কোথাও গিয়ে হয়তো একটু ছড়িয়ে ফেলবেন লেখক, কিন্তু সেটাতেও আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। আর এই ভুল প্রমাণিত হওয়ার জন্যই বইটা এতো ভালো লাগলো। লেখক এতো ক্ষুরধার হাতে কাহিনী লিখেছেন যে ছড়ানো তো দূর, বরং অতি সুক্ষভাবেই রহস্যের জাল বুনেছেন। আর পাঠক পুরো হিমশিম খাবে সেই জালের ধাঁধাগুলোর সমাধান করতে গিয়ে। আর এই হিমশিম খাওয়ার জন্যই কোথাও বোরিং ফিল হবে না। বরং মনে হবে এটা কীভাবে হচ্ছে, এরপর কী হতে চলেছে। আর এই এরপর কী হবে ভাবতে ভাবতেই পাঠক শেষ পাতায় চলে আসতে বাধ্য। যেমনটা আমার সাথে হলো।
তবে শেষে এসে লেখককে কুর্নিশ জানাবো এর অসাধারণ ক্লাইম্যাক্সের জন্য। সমান্তরালভাবে চলা দুটো কাহানীকে যেভাবে এক সুতোয় বেঁধে তিনি পাঠকের সামনে মেলে ধরলেন তা প্রশংসনীয়। আর এখান থেকেই বোঝা যায়, রহস্য উপন্যাস লেখায় তাঁর হাত কতটা দক্ষতাপূর্ণ।
ভালো কথা তো অনেক বললাম, তাহলে কি খারাপ কিছু লাগেনি?
না, লাগে নি। কয়েকটা বানান ভুল ছাড়া, এই উপন্যাসের কোনো খারাপ দিক নেই। চোখ বন্ধ করে কিনে, পড়ে ফেলার মতো বই এটা।
সবশেষে এটাই বলবো, বহুদিন পর একটা দূর্দান্ত থ্রিলার পড়লাম। যা পড়ার পর শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছে, চোখের সামনে যাই দেখো না কেন, তাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা উচিত নয়।
পাঠকদের বলবো, বইটা একবার পড়ে দেখবেন। খুব ভালো লাগবে। পাঠে থাকুন।
"Yesterday upon the stairs
I met a man who wasn't there
He wasn't there again today
I wish, I wish he'd go away"
শেষ মৃত পাখি - শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশক - সুপ্রকাশ
প্রচ্ছদ - সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য - ৫২০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৪০২
Comments
Post a Comment