Posts

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

Image
"সে-সময়ে লেটারপ্রেসের দক্ষ কম্পোজিটদের বাজার-মূল্য ছিল। কোনো প্রেসের দক্ষ কম্পোজিটরদের অন্য প্রেস বেশি মজুরি কবুল করে ডেকে নিয়ে যেত। সুতরাং কলকাতার ক্লাবে ফুটবলারদের দলবদলের মতো কম্পোজিটররাও অনবরত প্রেস বদল করতেন। মেজো জ্যাঠামশাইয়ের কথা আলাদা, মেজোমা হাতে না ধরিয়ে দিলে 'ধুকুট্টি'-ময়লা বা 'ছিরকুট্টি' ছেঁড়া ধুতি বদলাতেও তিনি জানতেন না। কিন্তু ছোড়দি যেমন ভারতী প্রেসের অঘোষিত 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর' ছিল, তেমনই যতদিন লিপিকা প্রেস টিকেছিল, ততদিন ভূপালবাবু সেখানেই একাদিক্রমে কাজ করে গেছেন। পঞ্চাদার কাছে বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের সাধের পত্রিকা ছাপতে এসে প্রেস-সম্পর্কে আমাদের এই প্রজন্মের বহুতর অভিজ্ঞতা হলো। পঞ্চাদা প্রায় নিখরচায় মাস-চারেক পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা ছেপে দেবার পর সেই উচ্চকিত, আদর্শপীড়িত, প্রশ্নসংকুল, ক্ষুব্ধচিত্ত, তিরস্কার ও ভর্ৎসনাপ্রবণ, স্বপ্নদর্শী পত্রিকাটি পৃষ্ঠপোষণার অভাবে বন্ধ হয়ে গেল। 'গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা'র জন্য হরিনাথকে শাসকের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, ক্ষমতাবানদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সম্ভাব্যক্ষেত্রে পাঠকচিত্ত জাগরিতও হয়েছে—কিন্তু

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

Image
আমাদের মতো বৃহৎ ও একান্নবর্তী পরিবারের অভিভাবকেরা-বাবা-কাকা-জ্যাঠামশাইরা দেশ-কাল-পরিস্থিতির অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব পেরিয়ে এসেছিলেন। প্রাক-স্বাধীনতাপর্বের আদর্শ ও আবেগাচ্ছন্ন রাজনীতি, সমাজনীতি ও সাংবাদিকতার জগৎ, সেকালের উদ্দীপিত সাহিত্যান্দোলনের বাঁকগুলির মধ্যে দিয়ে গেছেন তাঁরা। মন্দা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা, খণ্ডিত স্বাধীনতা দেখেছিলেন তাঁরা এবং তার ফলাফলও প্রত্যক্ষত ভোগ করতে হয়েছিল তাঁদের। নিজেদের প্রেস বিক্রি করে দিয়ে পরের প্রেসে ম্যানেজারির চাকরি করাটা নতুন কিছু ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জননী' উপন্যাসে প্রেস মালিক শীতলের ভাগ্যনাশ হয়েছিল নিজের উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে। মানিক বলেছেন শীতলের প্রেসের আয় ভালো ছিল। বন্ধুদের নিয়ে পান-ভোজনে অতিরিক্ত অর্থব্যয়ই তার ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের কারণ। কিন্তু শ্যামা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। শ্যামাকে বিয়ের আগে উচ্ছৃঙ্খলা কি দেখা দেয়নি? নাকি প্রেস বিক্রি করে দেওয়ার পেছনে সে-সময়ে দেখা দেওয়া পৃথিবী-জোড়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভারতীয় কলোনিয়াল অনুবৃত্তির নিঃশব্দ ঘাতকের হাত ছিল না! তাই-ই যদি না হবে তবে প্রায় একই সময়ে লেখা 'পদ্মানদীর মাঝ

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

Image
"মেজো জ্যাঠামশাইদের নবপ্রভাত মুদ্রণালয় ছাড়াও কুঠিডাঙায় তখন অনেকগুলি প্রিন্টিংপ্রেস। শুধুমাত্র কুঠিডাঙা মোড়ের আশেপাশেই আট-নটি প্রেস ছিল। তারই একটি—ভারতী প্রেসে আমাদের ছোড়দি হেড কম্পোজিটরের কাজ করত। ছোড়দি মেজো জ্যাঠামশাইয়ের মেজো মেয়ে, সে কী করে ছোড়দি হলো তা বলা মুশকিল। আসলে বড়ো, মেজো, সেজোর পরে পরিবারের চতুর্থ কন্যা ছোড়দি। তার পরের দিদিরা ফুল, ন, লাল, চিনি, ভালো, সুন্দর—ইত্যাকার অভিধায় না-কুলোনোয় নামের পেছনে দিদি লাগিয়ে ডাকা হতো—পুটিদি, কুটিদি, ছুটিদি, ফুচুদি, রুণাদি ইত্যাদি। অন্য দিদিদের যথাসময়ে বিয়ে হলেও ছোড়দি বিয়ে করেনি। তার কারণ নিয়ে সে-সময় আমরা মাথা ঘামাইনি। আমরা শুধু জানতাম লম্বা-চওড়া, শক্ত-সমর্থ, ঈষৎ পুরুষালি চেহারার আমাদের ছোড়দি হলো রিজিয়া সুলতানার মতো বীরাঙ্গনা এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে ফরাসি এনসাইক্লোপিডিস্ট পণ্ডিতদের মতো জ্ঞানশালিনী, এবং ছোড়দি আমাদের কাছে ছিল চলমান ডিকশনারি। বাংলা আর ইংরেজি বানানের ব্যাপারে এত বড়ো রেডি-রেকনার আজও চোখে পড়েনি। আমরা জানতাম ছোড়দি যত রাতেই বাড়ি ফিরুক না কেন বাড়িতে আনন্দের লহর বয়ে যাবে—আমরা ছোটোরা পাবো একটা করে লজেন্স, টফি, পেন্সিল বা রঙপেন্সিল জাতী

নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।

Image
'উই হাভ আ প্রে। আ প্রে।' মাস্তুলের মাথায় আড়াআড়ি ভাবে বাঁধা ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল জন। এই সপ্তাহে তার ওপরে নজরদারির দায়িত্ব। জাহাজের কিছু কাজ দলের সকলকে পালা করে করতে হয়। মাস্তুলের মাথায় চড়ে একভাবে চারপাশের দিগন্তে চোখ বোলানো এমন একটা কাজ। ছড়িয়ে থাকা অসীম নীলের মাঝে কোনো কালো বিন্দু নিজরে এলেই সতর্কবার্তা ছুঁড়ে দিতে হয়। জন পুব দিগন্তে একটা বড়ো কালো বিন্দু দেখেই চিৎকার করে উঠেছে। হু হু বাতাস আর জাহাজের কাষ্ঠল শরীরে ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দে তার ভাঙা স্বর হারিয়ে গেল। সচল বিন্দুকে দেখে নিশ্চিত হয়ে আরও একবার চেঁচিয়ে উঠল সে, 'ক্যাপ্টেন, শিকার। ডাইনে শিকার।' 'শিকার' শব্দটা কানে বাঁধতেই ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা জনের দিকে নজর ফেরাল এডওয়ার্ড। ডানহাত তুলে কিছু দেখাতে চাইছে ছেলেটা! ডেক থেকে বাঁ পা তুলে বোস্প্রিট ধরে কিছুটা এগিয়ে গেল সে। তার পায়ের ঠিক নিচে অস্থির তরঙ্গমালা। গত পাঁচদিন ধরে তারা বার্বাডোসের পশ্চিমে সেন্ট ভিনসেন্ট আগ্নেয়দ্বীপের আশেপাশে অলসভাবে ঘোরাঘুরি করছে। শিকারের আশায়। জায়গাটা বাছাই করার পেছনে এডওয়ার্ডের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস নি

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

Image
'হস্ত-প্রক্ষালন' কথাটি ব্যবহার করতেন প্রবীণতম কম্পোজিটার সুবলবাবু। টিফিন আওয়ার শুরু হওয়ার মুখে ছোকরা ইঙ্কম্যান অনিল দাস কম্পোজ ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠতেন—'চলুন দাদাসকল, বাবুসকল, কাকাসকল—মধ্যাহ্নকালীন পিণ্ডপাতের আগে আমরা হস্ত-প্রক্ষালনে যাই।' ঐ মলিন পরিবেশ, কালিমালিপ্ত দেওয়াল, প্রতপ্ত টিনের চালার জ্বলুনি—সবকিছু অগ্রাহ্য করে হাসির হররা উঠত ঘরটির মধ্যে। সত্যি কথা বলতে গেলে আহার-পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই 'হস্ত-প্রক্ষালন'! কেননা, সিসার টাইপ তৈরি করা হতো বিমিশ্রিত সংকর ধাতু দিয়ে। সুবলবাবুর কথায়—যার মধ্যে সাধারণভাবে থাকত ৫৪-৮৬ শতাংশ সিসা, ১১-২৮ শতাংশ অ্যান্টিমনি এবং ৩-১৮ শতাংশ টিন। অতুল সুর জানিয়েছেন যে, সিসার সঙ্গে অল্প পরিমাণ বিসমাথ নামক ধাতুও মেশানো হতো। (বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর) রাসায়নিকভাবে এর সাথে আর্সেনিক ও অ্যান্টিমনির মিল আছে। অ্যান্টিমনি সিসার মতো নরম এবং ছুরির সাহায্যে কর্তনযোগ্য ধাতুকে শক্ত করে, টিনও ধাতুকে শক্ত করে, অ্যান্টিমনির ভঙ্গুরতা নিয়ন্ত্রণ করে। এই বস্তুগুলোর কোনোটাই মানব-শরীরের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক নয়। সিসা মানবদেহের পক্ষে তো

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর।। এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

Image
"পুরুষ-পরম্পরায় প্রায় এক শতকের লেটার-প্রিন্টিংপ্রেসের বা সাধারণ ছাপাখানার একটি বিশ্বস্ত ও প্রত্যক্ষ ছবি ছিল আমাদের বৃহৎ পরিবারের পরম্পরায় বেড়ে-ওঠা ভাই-বোনেদের কাছে। সে-অর্থে আমাদের পরিবারটিকে প্রেস-পরিবারই বলা চলত। প্রেস, নিকট-অতীতের লেটার-প্রিন্টিংপ্রেস মানে কী? প্রেস মানে তো একটা পরিচিত সাদা-কালো ছবি! মলিন ঘরে সস্তার কাঠের টেবিল, গুটিকতক চেয়ার, বেয়াড়া মাপের টুল অথবা নাতিদীর্ঘ বেঞ্চি—এই হলো সদর; আর অন্দরে আধো-অন্ধকার-সমাকীর্ণ একটি-দুটি ঘরে কালিমাচিহ্নিত দেওয়াল, মলিন চেহারার কয়েকটি নাতি-উচ্চ কেস-র‍্যাক—যেখানে ঢুকিয়ে রাখা টাইপ-কেস, ঢালওয়ালা কিন্তু চালাহীন কম্পোজ স্ট্যান্ডের ওপরে ও স্ট্যান্ড ঘিরে রক্ষিত টাইপ-ভর্তি চৌকোণা খোপওয়ালা কেসগুলো। প্রেসের আয়তন ও সামর্থ্য-অনুযায়ী এমন টাইপ-স্ট্যান্ডের সংখ্যা, প্রত্যেকটি স্ট্যান্ডের সামনে কাঠের টুল। ঢালওয়ালা অংশে সাড়াসাড়ি এবং সামনের অংশে আনুভূমির উপায়ে রক্ষিত টাইপ-কেসের সামনের টুলে কুলোর মতো পিঠ নিয়ে বসে থাকা কয়েকটি মানুষ। চারদিকে কালিমালিপ্তির বহুবিধ চিহ্নের মতোই তাঁদের হাতদুটি, তাঁদের বাঁ-হাতে কম্পোজিং স্টিক ডানহাতের দ্রুত চলাচল সঠিক টাইপের স

পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি ।। (নদীয়া জেলার খ্রিস্টমেলা)।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ।।

Image
"তখনও কৃষ্ণনগর শহরটা গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন নদীয়া বা নবদ্বীপের কাছেই ছিল 'রেউই' নামে একটি গ্রাম। মূলত গোপ বা গোয়ালাদের বাস। এই গোপদের আরাধ্য ছিল কৃষ্ণ। ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, জলঙ্গী নদীর দক্ষিণ ধারে গড়ে ওঠা এই জনপদে ভবানন্দ মজুমদারের পুত্র রাঘব রায় মাটিয়ারি থেকে বাস তুলে বসতি গড়ে তুললেন রেউই গ্রামে। ভবানন্দ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। ফলে বংশানুক্রমিকভাবে তারা রাজা হয়ে গেলেন। রাঘব রায় তৈরি করলেন রাজবাড়ি। তারই ছেলে রুদ্র রায় গোপদের মহাসমারোহে কৃষ্ণপূজা দেখে এবং কৃষ্ণের প্রতি নদীয়াবাসীর ভক্তি দেখে গ্রামের নাম দিলেন 'কৃষনগর'। গড়ে তুললেন রাজধানী করে। বাংলায় পর্তুগিজ আগমন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রসারের প্রাক্কালে নদীয়া বা কৃষ্ণনগরে খ্রিস্টধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। ১৮৩২ সালে নদীয়ার চাপড়া অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্ট মতাবলম্বী সি এম এস বা চার্চ মিশনারি সোসাইটির পুরোহিত রেভা দিরে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। কৃষ্ণনগরেও তখন প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রভাব রয়েছে। এই শহরে ক্যাথলিক মিশনারিদের প্রথম পদার্পণের খবর পাওয়া যায় ১৮৪৫ সালে। ফাদার জুবিবুরু নামে এক ক্যাথলিক মিশনারি ১৮৪৫ সালে