Posts

সৌভাগ্যশলাকা।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ

Image
পালাতে চাইছে গায়াস। প্রাণপণে ছুটে চলেছে। পিছনে, খুব কাছে চলে এসেছে ভয়ংকর প্রাণীটা! অতিকায় চেহারা। হাওয়ায় উড়ছে সোনালি কেশর। বিরাট মুখগহ্বর থেকে মুহুর্মুহু হুংকার বেরিয়ে আসছে। প্রতিবার সেই গর্জনে কেঁপে উঠছে গায়াসের পায়ের নীচের মাটি। তার উত্তপ্ত নিশ্বাস নিজের শরীরে অনুভব করতে পারছে গায়াস। আর সামান্য পথ। ওই তো, সামনেই বয়ে চলেছে টাইবার নদী। একবার, কোনোক্রমে একবার যদি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তাহলেই বেঁচে যাবে সে। 'দ্রুত... আরও দ্রুত!' গায়াস নিজেকে চিৎকার করে বলল। ক্লান্ত পা দুটো তার কথা শুনতে আপত্তি জানাচ্ছে। মনের শাসন মানছে না। কামড়ে ধরছে পায়ের পেশি। পাঁজর ভেঙে ফুসফুস বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে। 'আর মাত্র একশো পা।' কথাটা বললেও প্রতিরাতের মতো আজও এই একশো পা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারল না গায়াস। প্রবল জিঘাংসায় উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল পশুরাজ। তার শরীরের ভার নিয়ে ঘাসে লুটিয়ে পড়ল রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াস। হাতের খাটো বর্শা দূরে ছিটকে পড়ল। সুতীক্ষ্ণ বঁড়শি যেভাবে লোভী মাছকে গেঁথে ফেলে, হিংস্র পশুটির নখপ্রান্ত ঠিক সেভাবে রোমান সেঞ্চুরিয়ানের ধাতব বর্ম ভেদ করে শরীরে চেপে বসল। তীব্র ...

সৌভাগ্যশলাকা।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ

Image
মানববর্জ্য এবং আবর্জনায় ভরে রয়েছে সংকীর্ণ গলিপথ। তাঁর নিজের নৈতিকতা-বিবর্জিত, উৎকোচে ভরা এবং অজস্র অযোগ্য বিচারে কলুষিত জীবনের মতোই দুর্গন্ধময় পথটুকু পিলেত নিঃসংকোচে পার করলেন। শহরের দুই প্রধান রাস্তার সংযোগকারী সংকীর্ণ গলির অপরপ্রান্তে পৌঁছে বিদ্রোহী ফুসফুসকে শান্ত হতে কিছুটা সময় দিলেন তিনি। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে জরিপ করে নিলেন এ প্রান্তের পরিবেশ। স্বাভাবিক। কয়েক পা দূরে রাস্তার পাশে পরপর কয়েকটা দোকান। এক বৃদ্ধা সম্ভবত তাঁর বংশজকে নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত। ব্রোঞ্জের তৈরি একটা ছোট্ট ঘোড়া নিয়ে দোকানির সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। স্বস্তির শ্বাস নিলেন বর্তমানে রোমের সবচেয়ে চর্চিত মানুষটি। 'তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো।' সন্ত্রস্ত ভৃত্যদের নির্দেশ দিয়ে পিলেত গলিমুখ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর ক্লান্ত পায়ে দরদামে নাছোড় দোকানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সম্ভ্রান্ত পোশাকে উঁচুদরের ক্রেতা ভেবে দোকানি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। 'আমি কি এখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে পারি?' ভেঙে পড়া স্বরে অনুরোধ জানালেন এক সময়ের আদেশকারী জুডেয়ার প্রশাসনিক প্রধান। দোকানিকে প্রথমে হতাশ দেখাল। কয়েক মুহূর্ত সে নিষ্পলকে চে...

উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ।।

Image
অনেকদিন পর স্মৃতির শহরে পা দিয়ে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অবিরত চেনামুখগুলো কোথাও ধূসর, কোথাও ছায়া ভেঙে সামনে চলে আসে। কখনো আবার কোনো প্রাচীন ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। তারপর দন্তবিহীন মাড়ি ছাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, কীরে, কেমন আছিস? কবে এলি? তখন তার ঘোলাটে চোখ চকচক করে ওঠে। বেরিয়ে আসতে চায় দ্যুতি। ছুটোছুটি করতে চায় সামনে ছড়িয়ে থাকা সবুজ মাঠের ওপর। তাকিয়ে থাকি আমিও। উত্তর দিই, ভালো। কাল এসেছি। তুমি কেমন আছ? —এই আছি। তোর ঘরের খবর কী? সব ভালো তো? কুশল সংবাদ বিনিময় চলছে, আর আমি ভেতরে ভেতরে হাতড়ে চলেছি নাম। এই প্রাচীনের নামটা মনে করতে পারছি না। প্রাচীনত্ব কিছুক্ষণ দম ধরে বসে রইল। তারপর পেনাল্টি কিক মারার মতো শব্দ ছিটকে দেয়, ‘মনাটা মরে গেল।’ কোনো আবেগ নেই। দুঃখ নেই, শুধু সংবাদ। সেই ছিটকে আসা শব্দ দু-হাতে লুফে নিয়ে বললাম, ও তো আলাদা বাড়ি করেছিল। —বড়দাকে মনে আছে? সুনীলদা? সেও মারা গেছে। —শুনেছি। কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে নামটা ভেসে উঠল-- নীরজদা। ভালো ফুটবল খেলত। শহরে প্রথম ডিভিশনে খেলত। কাজ করত কারখানায়। খেলা, কাজ আর সংসার নিয়েই ছিল তার যাপন। এখন, এই প্রাচীন বয়সে বাড়ির সামনে একটা গুমটি চায়ের দোক...

সৌভাগ্যশলাকা।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ

Image
করোটি পাহাড়ে উঠে আসার মুখে, একটা পাথরে নিজের ভর সঁপে বসে ছিল গায়াস। তার সেনা-পোশাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়েছে। গতকালের ভিড় অদৃশ্য হয়েছিল সন্ধের আগেই। তারপর থেকে ক্রুশবিদ্ধ শরীরগুলো পালা করে পাহারা দিয়ে গেছে অধীনস্থ সামারিটান সৈন্যরা। ক্লান্ত ছিল তারাও। আটদিন ধরে চলা নিস্তারপর্বে শহরে বহু পুণ্যার্থীদের আসা যাওয়া লেগে থাকে। সেই সময় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কম শক্তিক্ষয় হয় না। নিস্তারপর্ব মিটতে না মিটতেই আবার বিচারসভা বসেছিল। সে-ও এক অশান্তির পরিবেশ। আর তারপর গতকালের অস্থিরতা। সবকিছু সামলানোর পরে একটু বিশ্রাম তাদেরও প্রাপ্য। এক রোমান সেঞ্চুরিয়ানকে করোটি পাহাড়ের মুখে উঠে আসতে দেখে নিজের ভাবনা থেকে সরে এল গায়াস। একটু দূরেই গভর্নর পিলেতের ব্যক্তিগত সচিব ম্যালিনাস উদাস মুখে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বাঁধা পড়ে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ নাজরাতীয় জিশুর নিষ্প্রাণ শরীরে। ম্যালিনাসকে আগে কখনো এতটা বিচলিত হতে দেখেনি গায়াস। বিচার শেষে এমন পরিণতি নতুন নয়। গলগাথার রাস্তায় এমন সারিবদ্ধ ক্রুশের অবস্থিতি বিষণ্ণতা এবং ভয় মিশ্রিত এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জন্ম দেয় বটে, তবে তা সাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেক্রেটারি ম্...

সৌভাগ্যশলাকা।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ

Image
ভিড়টা করোটি পাহাড়ে উঠে এসেছে অনেকক্ষণ। সাব্যাথের আগেই যাবতীয় কাজ শেষ করতে হবে। এমন নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল। সামারিটান সৈন্যরা খুশিমনে তা পালনে ব্যস্ত। ইহুদিদের প্রতি তাদের জন্মগত ঘৃণা। ফরীশী হোক কিংবা সদ্দূকী সম্প্রদায়ের— ধর্মগতভাবে ইহুদি হলেই তাদের প্রতি নিজেদের মনের ভাব সামারিটানরা আর আড়ালে রাখে না। শুরু থেকেই তারা দীর্ঘ দশকের সঞ্চিত ঘৃণা উজাড় করে দিয়েছে নাজরাতীয় জিশুর প্রতি। কাইয়াফাস ঠিক সেরকম নির্দেশই দিয়েছিলেন— অনুরাগীদের সামনে তাদের প্রভুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার। গায়াস নিজে সেই পাপকার্যে অংশগ্রহণ করেনি, তবে নীরব ছিল। মান্য করার এক সুদীর্ঘ অভ্যাস তাকে চালিত করেছে। কিন্তু এরপর যা হতে চলেছে, তা সহ্য করা অসম্ভব মনে হচ্ছে। ওই তো, একজন সামারিটান সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে ক্রুশবিদ্ধ মানুষটার দিকে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। অপরাধীর পা দুটো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যাতে মৃত্যুর আগেও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভবে অতৃপ্তি না থাকে। খানিক আগে বাকি দুই সাধারণ অপরাধীদের ক্ষেত্রেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ক্রুশবিদ্ধকরণের এ এক বহু অভ্যাসজনিত পদ্ধতি। গায়াসের হাতের মুঠো অজান্তেই আরও জোরে চেপে বসল প্রাচীন বর্...

উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ।।

Image
হ্যাঁ, অল্পস্বল্প আলাপ হয়েছিল সিনেমাপাড়াতেই। কোনো এক সিনেমার শুটিং পর্বেই আলাপ। খুব মিশুকে লোক ছিলেন তিনি, জমিয়ে আড্ডা দিতে পারতেন। বললেন, ‘তুমি তো বসুশ্রী কফি হাউসে বসো।’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তখন রবিবার সকালে আমি, তরুণ চৌধুরী আর কয়েক জন বসুশ্রী কফি হাউসে বসতাম। শিয়ালদার বোর্ডিং হাউসে থাকি তখন। ওই বসুশ্রীতেই অন্যপাশে অনিল চট্টোপাধ্যায় বসতেন কয়েক জন সিনেমা-লেখকের সঙ্গে। তাঁরা সিনেমা সমালোচনা ছাড়াও তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে লিখতেন। তবে, সিনেমাপাড়ার সঙ্গে তেমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ওখানেই তিনি দেখেছিলেন আমাকে। শুটিং-এর ফাঁকে কথা বলতে বলতে বেশ জমে গেল। আসলে, তিনি তো ছিলেন আড্ডাবাজ। তবে, মাঝেমধ্যেই তিনি উধাও হয়ে যেতেন। চলে যেতেন ঘাটশিলায়। ওখানে ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতিরক্ষা কমিটি’র সভাপতি ছিলেন। সিনেমাপাড়ার শিল্পী-কলাকুশলী সংগঠনেরও তিনি শীর্ষে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চলচ্চিত্র উন্নয়ন পর্ষদের শীর্ষেও বোধ হয় ছিলেন বেশ কিছুদিন। এত সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও কিন্তু মানুষটা এক-শো ভাগ ছিলেন সিনেমার মানুষ। কয়েক দিনের আড্ডাতেই তিনি জেনে নিলেন আমার হাল-হকিকত। আমিও যে উড়নচণ্ডী, সেটা জেনে বললেন, আমিও তো উড়নচণ্ডী। এখন ...

উড়নচণ্ডীর পাঁচালি।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।। সুপ্রকাশ

Image
সত্যদার কথা বলেছি। সত্যদা—মানে, সত্য মজুমদার। পেশায় প্রযুক্তিবিদ, নেশায় বেহালাবাদক। বেহালা ছিল তাঁর আনন্দ, তাঁর আবেগ। সুরের সাধনায় তিনি নির্জন হয়ে যেতেন নিজের ভেতর। বোধ হয় তাঁর কখনো মন খারাপ করত না। কখনো মন এপাশ-ওপাশ করলেই বেহালায় ছড় টেনে সুরের নদীতে সাঁতার কাটতেন। ডুবসাঁতার। স্নাত হলে কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টির আঁচল ছড়িয়ে দিতেন নীলিমে। তারপর মৃদু হেসে বলতেন, বলো। বলার কিছু থাকে কি? শুধু তাঁর সঙ্গে স্নাত হওয়া ছাড়া। সুরের এই ঝরনাতলায় স্নান ছাড়া আর কী-ই-বা হতে পারে! সুরের মতোই তাঁর গভীর দু-চোখে ছিল আলোকবর্ণ। মাঝে মাঝে মনে হত, সারাদিন লোহালক্কড়ের সঙ্গে সহবাস করেও একটা সুরেলা মন কীভাবে পুষে রাখা যায় হৃদয় কোটরে! পরে বুঝেছি, সুর ও সংগীত পারে মানুষকে এভাবে গড়ে তুলতে। কোন ছোট্টবেলা থেকে দেখেছি তাঁকে। যখন আমরা পুব-পাকিস্তানের দর্শনায় ছিলাম, বাবা দর্শনার কেন অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কলে ছিলেন, সেখানেও ছিলেন তিনি। যখন আমরা চলে এলাম এপারের পলাশিতে, তিনিও এলেন। রামনগর কেরু অ্যান্ড সুগার কোম্পানি। সত্তর দশক পর্যন্ত রমরম করে চলত। পলাশির চিনি বিদেশে রপ্তানি হত। বাংলার বাজারে আসত। সত্তরের দশকেই মূলত শ্রমিক...